আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় পূর্ব বাংলার লেখা চর্যাপদ। এটি হল বাংলা ভাষার প্রাচীন গীতিকবিতার সংকলন। হারানো বলে মনে করা হলেও এটি বিংশ শতকের প্রথমে আবিষ্কৃত হয়। চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যে প্রথম যুগের সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত। এটি বাংলা ভাষার বিবর্তন এবং বাংলা সাহিত্যের প্রাথমিক পর্যায় সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু জানতে সাহায্য করে।
আজকের এই লেখায় আমরা চর্যাপদের আবিষ্কারের ইতিহাস, এই সংকলনের প্রাচীনতম কবি, তাঁর জীবনী এবং চর্যাপদের প্রাচীনতম কবিতাটি সম্পর্কে আলোচনা করব। এছাড়াও, চর্যাপদের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য এবং ছন্দোবিন্যাস নিয়েও আমাদের আলোচনা থাকবে। চর্যাপদের আদি কবি ও তাঁর সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব এবং বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান নিয়েও আলোচনা করা হবে।
চর্যাপদ সাহিত্যের প্রাচীনতম সংকলন নিয়ে আজকের আলোচনা।
আজকের প্রসঙ্গটি চর্যাপদের সবচেয়ে প্রাচীন সংকলন সম্পর্কে। বৌদ্ধ সাধকদের রচনাবলি নিয়ে গঠিত এই চর্যাপদ সাহিত্যের উৎপত্তি ১০ম থেকে ১২শ শতাব্দীতে। আর চর্যাপদের আদি কবিরূপে পরিচিত হন লুইপা। তাঁর রচিত বহু চর্যাপদই আমাদের কাছে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।
লুইপা ছিলেন একজন বৌদ্ধ সাধক। তিনিই প্রথম চর্যাগীতি রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত চর্যাগীতিগুলো বৌদ্ধ ধর্মীয় দর্শন ও তত্ত্ব দ্বারা অনুপ্রাণিত। এতে তিনি মূলত মানুষের মুক্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতির কথা বলেছেন। তাঁর ভাষা সরল এবং সহজবোধ্য। তিনি প্রতীক ও রূপকের মাধ্যমে তাঁর চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছেন।
লুইপার চর্যাগীতির মধ্যে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
- বৌদ্ধ ধর্মের মূল তত্ত্ব
- ধ্যান ও যোগের গুরুত্ব
- মুক্তির উপায়
- প্রেম ও ভক্তি
- সামাজিক অবস্থা
চর্যাপদ সংকলনের আবিষ্কারের ইতিহাস এবং প্রেক্ষাপট
চর্যাপদের আবিষ্কারের ইতিহাস এবং প্রেক্ষাপট একটি চিত্তাকর্ষক গল্প। 1907 সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে তালপাতার লেখা কয়েকটি পুঁথি পান। ওই পুঁথিতে সংকলিত ছিল 47টি গান, যা পরবর্তীতে ‘চর্যাপদ’ নামে খ্যাতি লাভ করে। এই আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা।
এই চর্যাপদগুলি প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছিল এবং 10 থেকে 12 শতকের মধ্যে রচিত বলে মনে করা হয়। এই গানগুলি বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের দ্বারা রচিত হয়েছিল, যারা তান্ত্রিক অনুশীলন এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অন্বেষণের জন্য পরিচিত ছিলেন। চর্যাপদগুলি বাংলা ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্যকর্ম হিসাবে পরিচিত এবং তাদের ভাষা, সুর এবং কাব্যিক সৌন্দর্যের জন্য প্রশংসিত।
চর্যাপদগুলির আবিষ্কারের প্রেক্ষাপটও মনোরম। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একজন সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন যিনি বৌদ্ধ সাহিত্যে আগ্রহী ছিলেন। তিনি নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে সংস্কৃত পাণ্ডুলিপিগুলির অনুসন্ধান করছিলেন যখন তিনি তালপাতার লেখা ওই পুঁথিগুলির সন্ধান পান। পুঁথিগুলি অবহেলিত অবস্থায় ছিল এবং তাদের মূল্য বোঝা যায়নি।কিন্তু শাস্ত্রী এগুলিকে চিহ্নিত করেন এবং তাদের গুরুত্ব বুঝতে পেরে কলকাতায় নিয়ে আসেন।
চর্যাপদের আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। এটি বাংলা ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্যকর্মের আবির্ভাব ঘটায় এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে। চর্যাপদগুলি আজও বাংলা সাহিত্যের একটি প্রধান অংশ এবং তাদের ভাষা, সুর এবং আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টির জন্য প্রশংসিত হয়।
চর্যাপদের প্রাচীনতম কবি কে, তাঁর জীবনী এবং সাহিত্যকর্ম
প্রাচীনতম কবি হিসেবে পরিচিত হন শান্তিপদ। তিনি বৌদ্ধধর্মের একজন মহাসিদ্ধ ছিলেন এবং চর্যাপদের ষোলটি গান রচনা করেছিলেন। তাঁর জীবন সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে তাঁর সাহিত্যকর্ম থেকে জানা যায় তিনি বৌদ্ধ ধর্মের বজ্রযান সম্প্রদায়ের অনুসারী ছিলেন। তাঁর চর্যাগীতগুলিতে তান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। শান্তিপদের চর্যাগীতগুলি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত হয়।
চর্যাপদ সংকলনের প্রাচীনতম কবিতাটি, এর ভাষা এবং সাহিত্যিক গুরুত্ব
চর্যাপদ সংকলনের প্রাচীনতম কবিতাটি হল ময়নামতীর “আদি কবির গান”। এই কবিতাটির ভাষা প্রাচীন বাংলা ভাষার একটি খুবই প্রাচীন রূপ, যাকে প্রাচীন বাংলা বা গৌড়ীয় বলা হয়। এই ভাষাটি সংস্কৃত ভাষার প্রভাব বিস্তারের আগে বাংলা ভাষা কেমন ছিল, সে সম্পর্কে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়।
এই কবিতাটির সাহিত্যিক গুরুত্বও অপরিসীম। এটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রাচীনতম পরিচিত কবিতা। এটি চর্যাপদ সাহিত্যের একটি প্রধান উদাহরণ, যা বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চর্যাপদগুলি বাংলা ভাষার প্রাচীনতম ধর্মীয় কবিতা, যা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের দ্বারা রচিত হয়েছিল। এই কবিতাগুলির মধ্যে আদি কবির গানটি সবচেয়ে প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ। এটি বাংলা ভাষার ইতিহাস এবং বিকাশের অধ্যয়নের জন্য একটি অমূল্য সামগ্রী।
চর্যাপদের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য এবং ছন্দোবিন্যাস
চর্যাপদগুলি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন। এগুলি বৌদ্ধ দোহা গান, যা প্রায় 1000-1200 খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়েছিল। চর্যাপদগুলি তাদের অনন্য ভাষাগত বৈশিষ্ট্য এবং জটিল ছন্দোবিন্যাসের জন্য পরিচিত।
চর্যাপদগুলি মূলত বৌদ্ধ সংস্কৃত এবং পালিতে রচিত হয়েছিল, তবে এতে প্রচুর সংস্কৃত, প্রাকৃত এবং দেশজ বাংলা শব্দও রয়েছে। এই ভাষাগত মিশ্রণটি চর্যাপদগুলিকে একটি অনন্য এবং আকর্ষণীয় সাহিত্যিক রূপ দেয়।
ভাষার পাশাপাশি, চর্যাপদগুলি তাদের জটিল ছন্দোবিন্যাসের জন্যও পরিচিত। প্রতিটি চর্যাপদে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক পংক্তি থাকে, প্রতিটি পংক্তিতে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মাত্রা থাকে। এই ছন্দোবিন্যাসটি আবৃত্তি, অনুরণন এবং অলঙ্কারের মতো কাব্যিক裝置গুলির ব্যবহারের মাধ্যমে আরও জটিল হয়ে ওঠে।
চর্যাপদগুলির ভাষাগত বৈশিষ্ট্য এবং ছন্দোবিন্যাস তাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি অনন্য এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেয়। এই গুণাবলীগুলি চর্যাপদগুলিকে সাহিত্যিক অধ্যয়ন এবং উপভোগের একটি আকর্ষণীয় বিষয় করে তোলে।
চর্যাপদের আদি কবি ও তাঁর সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব এবং বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান
চর্যাপদের আদি কবির পরিচয় অজানা হলেও, তাঁর রচনাবলি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি অমূল্য সম্পদ। এটিই বাংলা ভাষায় লিখিত প্রাচীনতম সাহিত্যকর্ম। চর্যাপদের রচয়িতাদের ‘চর্যাপদ রচয়িতা’ বা ‘সিদ্ধাচার্য’ বলা হয়। এই কবিদের মধ্যে লুইপা, বিহঙ্গ, ময়নক, কাহ্নুপা, ভূষণপা, ডোম্বীপা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁরা বৌদ্ধ ধর্মের তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছিলেন। তাঁদের রচনায় বৌদ্ধ তত্ত্ব, মন্ত্রযানের সাধনা পদ্ধতি ও নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা প্রতিফলিত হয়েছে। চর্যাপদে প্রেম, বিরহ, আনন্দ, দুঃখ, বিরক্তি ইত্যাদি মানবিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। ভাষাগত দিক দিয়ে চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের উৎসধারা। এটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের ইতিহাস বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Leave a Reply