জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতা শুধু পাঁচটি দেশের কাছে কেন দেওয়া হয়েছে? এর ইতিহাস ও যৌক্তিকতা

জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতা শুধু পাঁচটি দেশের কাছে কেন দেওয়া হয়েছে? এর ইতিহাস ও যৌক্তিকতা

আমি আজ আপনাদের সাথে জাতিসঙ্ঘের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নিরাপত্তা পরিষদের বিষয়ে কথা বলব। বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় জাতিসঙ্ঘের ভূমিকা অনস্বীকার্য। জাতিসঙ্ঘের অঙ্গ হিসাবে নিরাপত্তা পরিষদ কীভাবে এই দায়িত্ব পালন করে, তা বুঝতে গেলে ভেটো ক্ষমতার গুরুত্ব অনুধাবন করা জরুরি। ভেটো ক্ষমতা নিয়ে বর্তমানে বিতর্কের পাশাপাশি বিভিন্ন মহল থেকে সংস্কারের দাবিও উঠছে। এই আলোচনায় আমরা ভেটো ক্ষমতার ইতিহাস, এর প্রেক্ষাপট, স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র নির্বাচনের যুক্তি, ভেটো ক্ষমতার ব্যবহার ও এর প্রভাব এবং ভেটো ক্ষমতার বিষয়ে বর্তমান বিতর্ক ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিশদে আলোকপাত করব।

বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার রক্ষণকারী সংস্থা হিসেবে জাতিসঙ্ঘের ভূমিকা

জাতিসঙ্ঘের রক্ষা কবচ হিসেবে ভেটো ক্ষমতার প্রদান মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে। সেই যুদ্ধে শান্তিরক্ষায় ব্যর্থ হওয়া আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘ যাতে আবার একই ভুল না করে, সেজন্য যুদ্ধের পরাজিত দেশ জার্মানিসহ বিজয়ী মিত্রপক্ষকে রাখা হয় ভেটো ক্ষমতার অধীনে। তারা হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন ও রাশিয়া। এই পাঁচটি দেশই জাতিসঙ্ঘের সুরক্ষা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। ভেটো ক্ষমতা বলতে বোঝায়, জাতিসঙ্ঘের সুরক্ষা পরিষদে নেওয়া যে কোনো প্রস্তাবকে এই পাঁচটি দেশের যেকোনো একটি দেশ ভেটো দিতে পারে। ভেটো দিলে সেই প্রস্তাব আর গৃহীত হয় না। এমনকি সুরক্ষা পরিষদের যে কোনো প্রস্তাবকে গৃহীত ঘোষণা করতে হলে অবশ্যই স্থায়ী সদস্য পাঁচটি দেশের অনুমোদন লাগে। সুরক্ষা পরিষদের অন্য দশটি সদস্য দেশের সর্বাধিক দুই বছরের মেয়াদ থাকে। তবে তাদের ভেটো ক্ষমতা নেই।

নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভেটো ক্ষমতার গুরুত্ব

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভেটো ক্ষমতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ক্ষমতা পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশকে (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্স) প্রদান করা হয়েছে। এই দেশগুলিকে এই ক্ষমতা দেওয়ার কারণ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব শান্তি ও সুরক্ষা বজায় রাখার জন্য তাদের প্রভাবশালী ভূমিকা।

ভেটো ক্ষমতা স্থায়ী সদস্য দেশগুলিকে নিরাপত্তা পরিষদের যেকোনো প্রস্তাবকে এড়িয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়। এর মানে হল যে, এই দেশগুলি যেকোনো প্রস্তাবকে প্রতিরোধ করতে পারে যা তারা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে মনে করে। এই ক্ষমতা নিরাপত্তা পরিষদকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রাখে যা কোনো স্থায়ী সদস্য দেশের জন্য অগ্রহণযোগ্য।

See also  জিন্নাহকে কেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পিতা বলা হবে না?

ভেটো ক্ষমতা কখনও কখনও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। কিছু সমালোচক যুক্তি দিয়েছেন যে, এই ক্ষমতা স্থায়ী সদস্য দেশগুলিকে অত্যধিক ক্ষমতা দেয় এবং এটি জাতিসংঘকে আরও গণতান্ত্রিক ও প্রতিনিধিত্বমূলক হওয়া থেকে বিরত রাখে। অন্যরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ভেটো ক্ষমতা বিশ্ব শান্তি ও সুরক্ষা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয়। তাদের যুক্তি হল যে, এই ক্ষমতা ছাড়া, স্থায়ী সদস্য দেশগুলি নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ করতে অনিচ্ছুক হবে, যা পরিষদকে কম কার্যকর করে তুলবে।

ভেটো ক্ষমতার ভবিষ্যত অনিশ্চিত। কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে যে, এই ক্ষমতা অপসারণ করা হোক অথবা ভেটো ব্যবহারের ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হোক। তবে, এই প্রস্তাবগুলির কোনোটিই এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। ভেটো ক্ষমতা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য হিসাবে বহাল রয়েছে এবং এটি ভবিষ্যতের জন্য কিভাবে বিবর্তিত হবে তা দেখা বাকি।

ভেটো ক্ষমতা প্রদানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং কারণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ। এই সংস্থার নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যকে ভেটো ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এই পাঁচটি দেশ হল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন এবং ফ্রান্স। ভেটো ক্ষমতার অর্থ হল, এই পাঁচটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদের যেকোনো প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে, এমনকি যদি অন্যান্য সব সদস্যই সেই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। এই ক্ষমতা দেওয়ার পেছনে ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে।

যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে, মিত্রশক্তিগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ প্রতিরোধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। তারা বিশ্বাস করত যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এই লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে তারা এও জানত যে নিরাপত্তা পরিষদ তখনই কার্যকর হবে যদি এর সদস্যরা একমত হয়। যদি নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা একে অপরের সিদ্ধান্তকে ভেটো দিতে পারে, তাহলে জাতিসংঘ তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে।

ভেটো ক্ষমতা দেওয়ার আরেকটি কারণ ছিল বিজয়ী শক্তিগুলির মধ্যে বিদ্যমান অবিশ্বাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তিগুলি একসাথে কাজ করেছিল, কিন্তু যুদ্ধের পরে তাদের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব তৈরি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এর মধ্যে শীতল যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে, বিজয়ী শক্তিগুলি এমন একটি ব্যবস্থা চেয়েছিল যা নিশ্চিত করবে যে নিরাপত্তা পরিষদ তাদের মধ্যে কারো বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। ভেটো ক্ষমতা এই লক্ষ্য অর্জনের একটি উপায় ছিল।

See also  আলাদীন কে ছিলেন: প্রদীপের অলৌকিকতার রহস্য উন্মোচিত

গুলি জানা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি জাতিসংঘের কার্যকারিতা বোঝার জন্য অপরিহার্য। ভেটো ক্ষমতা নিরাপত্তা পরিষদকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ প্রতিরোধে সাহায্য করেছে। তবে এটি জাতিসংঘকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির উপরও পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত রেখেছে। ভেটো ক্ষমতা একটি জটিল এবং বিতর্কিত বিষয়, এবং এর ভবিষ্যত অস্পষ্ট।

ভেটো ক্ষমতাধারী পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশের নির্বাচনের যুক্তি

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশকে ভেটো ক্ষমতা দেওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি যুক্তি রয়েছে। প্রথমত, এই পাঁচটি দেশ হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী মিত্রশক্তি, যাদের অবদান ছিল বিশ্বকে ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে। পুরস্কার হিসেবে এবং বিশ্বশান্তি রক্ষায় তাদের প্রভাব বজায় রাখার জন্যই তাদের এই ভেটো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে, যার ফলে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তগুলো অধিকতর আঞ্চলিক ভারসাম্যপূর্ণ হয়। উদাহরণস্বরূপ, চীন এশিয়া মহাদেশের, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স ইউরোপের প্রতিনিধিত্ব করে।

তৃতীয়ত, ভেটো ক্ষমতা পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশকে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তে তাদের অত্যাবশ্যক স্বার্থ রক্ষা করার একটি পদ্ধতি প্রদান করে। এর ফলে, কোনো একটি দেশ নিজের প্রয়োজনের কথা না ভেবেই অন্যের মতামত চাপিয়ে দিতে পারে এমন পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হয়।

চতুর্থত, ভেটো ক্ষমতা নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তগুলো আরও বেশি বিবেচনাপূর্ণ এবং সুষম করতে সাহায্য করে। কেননা, কোনো একটি দেশের ভেটো প্রয়োগ করার সম্ভাবনা থাকলে অন্য সদস্য দেশগুলো আরও বেশি যত্ন নিয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে এবং প্রয়োজনীয় সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করে।

অবশেষে, ভেটো ক্ষমতা কতিপয় বড় শক্তির মধ্যে উত্তেজনা এবং বিরোধ কমানোর ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে। যদি পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশের ভেটো ক্ষমতা না থাকত, তাহলে তারা অন্য সদস্য দেশগুলোর উপর তাদের প্রভাব ব্যবহার করে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত নিজেদের অনুকূলে প্রভাবিত করতে পারত। ফলে, অন্য সদস্য দেশগুলোর মনে ক্ষোভ এবং ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারত, যা আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারত।

See also  ইতিহাস: শিক্ষার দর্পণে অতীতের প্রতিফলন

ভেটো ক্ষমতার ব্যবহার ও এর প্রভাব

জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পুনরাবৃত্তি রোধ করা। এই লক্ষ্য অর্জনে নিরাপত্তা পরিষদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই পরিষদে পাঁচটি সদস্য রাষ্ট্রকে ভেটো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যাদের সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো প্রস্তাবই গৃহীত হতে পারে না। ভেটো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেই পাঁচটি দেশ হল- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং চীন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী হওয়া এসব দেশকে ভেটো ক্ষমতা দেওয়ার কারণ ছিল তাদের বিশাল সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি। তাদের সহযোগিতা ছাড়া নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো না। তাই তাদের সদিচ্ছা নিশ্চিত করতে ভেটো ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল।

এই ভেটো ক্ষমতার কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। যেমন, এটি বড় শক্তিগুলোর মধ্যে সংঘাত এড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও, নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তগুলো যাতে বাস্তবসম্মত এবং প্রয়োগযোগ্য হয় তা নিশ্চিত করতে ভেটো ক্ষমতা ভূমিকা রাখে। তবে ভেটো ক্ষমতার নেতিবাচক দিকও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এটি ছোট ও দুর্বল দেশগুলোর স্বার্থ উপেক্ষা করতে বড় শক্তিগুলোকে সুযোগ দেয়। এটি নিরাপত্তা পরিষদে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকেও ধীরগতিসম্পন্ন করে।

ভেটো ক্ষমতার ব্যবহারের কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটিশ এবং ফরাসি সেনাদের সুয়েজ খাল দখলের বিরুদ্ধে রাশিয়া ভেটো দিয়েছিল। একইভাবে, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপনে জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলো বারবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।

ভেটো ক্ষমতা একটি শক্তিশালী অস্ত্র যা নিরাপত্তা পরিষদে ব্যবহার করা হয়। এর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় প্রভাব রয়েছে। ভবিষ্যতেও জাতিসংঘের ভূমিকায় ভেটো ক্ষমতার গুরুত্ব অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়।

Pritom Avatar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *