আমার বন্ধুরা, আজ আমি তোমাদের সামনে তুলে ধরছি বাংলার ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, ফরায়েজী আন্দোলন। এই আন্দোলনটি ছিল বাংলার মুসলিম সমাজে একটি বিশাল পরিবর্তনের সূচনা। এটি সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার ও অবিচারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ স্বরূপ গড়ে উঠেছিল। ফরায়েজী আন্দোলনের ইতিহাস, উদ্দেশ্য, প্রভাব এবং উত্তরাধিকার সম্পর্কে জানতে আমাকে অনুসরণ কর।
ফরায়েজী আন্দোলন: একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ
ফরায়েজী আন্দোলন ছিল আঠারো শতকের শেষভাগ এবং ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ ভারতে সংঘটিত একটি সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলন। এই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিতুমীর, যিনি একটি গ্রামীণ জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। তিতুমীর বিশ্বাস করতেন যে ব্রিটিশ শাসন গণ্ডগোল এবং অন্যায়ের কারণ এবং মুসলমানদের তাদের শাসন থেকে মুক্ত হওয়া উচিত। তিনি একটি সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। যদিও তিতুমীর শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের দ্বারা পরাজিত হন, তবে তাঁর আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মডেল হিসাবে কাজ করে।
ফরায়েজী আন্দোলনের উদ্ভব এবং প্রেক্ষাপট
ফরায়েজী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট হল ১৮ শতাব্দীর শেষ ভাগ। তখন ব্রিটিশদের অধিপত্যে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। ব্রিটিশদের শাসন ব্যবস্থা এবং তাদের শোষণের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। জমিদারদের অত্যাচার এবং দুর্নীতিও মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছিল। এই পরিস্থিতিতে সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অসন্তোষের ফলস্বরূপ ফরায়েজী আন্দোলনের সূচনা হয়। ফরায়েজী আন্দোলনের সূচনাকারী ছিলেন হাজী শরীয়তউল্লাহ। তিনি তৎকালীন যশোর জেলার রামপাল গ্রামে ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন সুফি সাধক এবং ইসলাম ধর্মের প্রচারক। তিনি লোকদের বিদআত বা কুসংস্কার থেকে দূরে রেখে ইসলামের মূলনীতির প্রতি ফিরে আসার আহ্বান জানান। তিনি জমিদারি প্রথা ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধেও কণ্ঠস্বর তোলেন।
ফরায়েজী আন্দোলনের সূচনাকারী: হাজী শরীয়তুল্লাহ
হাজী শরীয়তুল্লাহ (রহ.) হলেন ফরায়েজী আন্দোলনের সূচনাকারী। তিনি ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলার রাজনগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন ধার্মিক এবং পious ব্যক্তি। তিনি প্রথমে আরবি, ফারসি এবং ইসলামী শিক্ষা অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি মক্কা ও মদিনা ভ্রমণ করে হজ ও ওমরাহ পালন করেন। হজ থেকে ফিরে এসে তিনি ফরায়েজী আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ইসলামী আইন ও বিধানের প্রতি মুসলমানদের ফিরে আসার আহ্বান জানান। তিনি সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধেও কণ্ঠস্বর তুলেন। তাঁর আন্দোলন দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অনেক অনুসারী অর্জন করেন। তাঁর আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়, যাকে ফরায়েজী বিদ্রোহ বলা হয়। হাজী শরীয়তুল্লাহ ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন, তবে তাঁর আন্দোলন তাঁর মৃত্যুর পরেও অব্যাহত থাকে।
শরীয়তুল্লাহর শিক্ষা এবং আন্দোলনের মূলনীতি
শরীয়তুল্লাহ্-এর শিক্ষা এবং আন্দোলনের মূলনীতি:
শরীয়তুল্লাহর শিক্ষাগুলি কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা নির্দেশিত ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ইসলামের শিক্ষাগুলিকে সঠিকভাবে অনুসরণ করতে, মুসলিমদের বাইবেলী আইন এবং ঐতিহ্যের মধ্যে পার্থক্য করা প্রয়োজন। তিনি শিয়া ও সুফিবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এবং তিনি ইসলামের অনুশীলনের সরলীকরণের আহ্বান জানান।
শরীয়তুল্লাহর আন্দোলনের মূলনীতি ছিল:
- কুরআন এবং সুন্নাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য
- শরিয়ত আইনের প্রতিষ্ঠা
- ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা
- মুসলিম সমাজে সংস্কার
- পশ্চিমা প্রভাবের প্রতিরোধ
শরীয়তুল্লাহর আন্দোলন ভারতীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি শুধুমাত্র মুসলিম সমাজে সংস্কারই নিয়ে আসেনি, বরং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
Leave a Reply