বাংলাদেশ নামকরণের ইতিহাস জানুন

বাংলাদেশ নামকরণের ইতিহাস জানুন

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্থান থেকে বাংলাদেশ নামক দেশের সৃষ্টি ও বাংলাদেশ নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে জানা উচিৎ সকল বাঙালির

যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তুপের মাঝে এক নতুন সূর্যের জন্ম হলো। জন্ম হলো বাংলাদেশের। আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা পড়েছি, শহীদদের কথা শুনেছি, স্বাধীনতার দিনের আনন্দে আনন্দিত হয়েছি। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন, আমাদের দেশের নামকরণ কীভাবে হয়েছিল? আজ আমরা এই প্রশ্নের উত্তরই খুঁজব। জানবো, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ নামকরণের সেই অজানা গল্প। এই গল্পে রয়েছে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের ছায়া, রয়েছে স্বাধীনতার প্রত্যাশা, রয়েছে বাঙালি জাতির আত্মবিশ্বাসের সাক্ষ্য। আজ আমরা সেই অতীতের পাতায় একবার আবার ফিরে যাবো।

বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ। ২০১৬ সালের দেশটির স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। সেই উপলক্ষে আজ জানি, কেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নামকরণ করা হয়েছিল ‘বাংলাদেশ’।

বাংলাদেশ নামকরণের ইতিহাস

১৯৭১ সালের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে জন্ম নেয়। পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে যে নতুন দেশটি গড়ে উঠল, তার নামকরণ করা হলো ‘বাংলাদেশ’। এই নামকরণের পেছনেও আছে একটি আকর্ষণীয় ইতিহাস।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামীদের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান থেকে একটি স্বতন্ত্র বাংলা ভাষাভাষী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তাই দেশের নামের ক্ষেত্রেও ‘বাংলা’ শব্দটি রাখার বিষয়ে সবাই একমত ছিলেন। তবে দ্বিতীয় অংশ নিয়ে ছিল কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। ‘দেশ’ শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আপত্তি উঠেছিল, কারণ এটি পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের নাম হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।

শেষ পর্যন্ত, ‘দেশ’ শব্দের বিকল্প হিসেবে ‘আদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ‘আদেশ’ শব্দটির অর্থ হলো ‘নির্দেশ’ বা ‘আদেশ’। অর্থাৎ, ‘বাংলাদেশ’ শব্দের অর্থ দাঁড়ালো ‘বাংলা ভাষাভাষীদের নির্দেশ’ বা ‘বাংলা ভাষাভাষীদের রাষ্ট্র’।

এভাবেই, মুক্তিযুদ্ধের পরে নতুন জন্ম নেওয়া দেশটির নামকরণ করা হলো ‘বাংলাদেশ’। এই নামটি শুধুমাত্র দেশের ভৌগলিক অবস্থানকেই প্রতিফলিত করে না, বরং এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশের জন্মলগ্নের ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ।

See also  বাংলার নবজাগরণের জনক হিসেবে পরিচিত ব্যক্তি

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্মমতা ও গণহত্যা থেকে বাঙালিকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নামকরণের বিষয়টি সামনে আসে।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও গণহত্যা থেকে বাঙালিকে রক্ষা করা এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সেই সময় স্বাধীন রাষ্ট্রটির নামকরণের বিষয়টি আলোচনায় আসে।

বাংলাদেশ নামের উৎপত্তি

বাংলাদেশ নামটির উৎপত্তি হয়েছে ‘বাংলা’ এবং ‘দেশ’ শব্দদ্বয় থেকে। ‘বাংলা’ শব্দটি প্রাচীন জাতি ‘বঙ্গ’ থেকে এসেছে, যারা বাংলা অঞ্চলের আদি অধিবাসী ছিল। ‘দেশ’ শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘ভূখণ্ড’ বা ‘অঞ্চল’। তাই, ‘বাংলাদেশ’ নামটি বাংলাভাষী মানুষের ভূখণ্ড বা দেশকে বোঝায়।

এই নামটি নির্বাচনের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, এটি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, এটি একটি স্বতন্ত্র এবং স্মরণীয় নাম, যা অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করে। তৃতীয়ত, এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নাম, যা বাংলাদেশের সমস্ত নাগরিকদের, নির্বিশেষে তাদের ধর্ম, জাতি বা ভাষা, একত্রিত করে।

তাই, বাংলাদেশ নামটি কেবল একটি নামই নয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ প্রথম উদ্যোগ নেন দেশের নামকরণ নিয়ে। তিনি ‘বাংলাদেশ’ নামটি প্রস্তাব করেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন দেশের নাম নিয়ে। তিনি ‘বাংলাদেশ’ নামটি প্রস্তাব করেন, যা বাংলা জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং বাংলা ভাষার স্বীকৃতিকে প্রতিফলিত করে। এ নামের সঙ্গে আরও কয়েকটি প্রস্তাব ছিল, যেমন ‘জয় বাংলা’, ‘গণ বাংলা’, ‘নব বাংলা’ এবং ‘সোনার বাংলা’। তবে ‘বাংলাদেশ’ নামটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হয়, কারণ এটি ছিল সব থেকে ব্যাপক, সহজ ও মার্জিত। এটি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং একই সাথে দেশের ভৌগোলিক অবস্থানকেও নির্দেশ করেছে।

See also  বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মূল বিভাজনকারী নদীটি কোনটি?

বাংলাদেশ নামের প্রভাব

নামটি বাঙালি জাতির সংস্কৃতি, সভ্যতা, ভাষা, ভূগোল ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটায়। ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল শ্রেণি ও পক্ষের কাছে সহজেই গ্রহণযোগ্য হয়।

বাংলাদেশ নামটি নির্বাচন করা হয়েছে দেশটির ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ভৌগোলিক অবস্থানের প্রতিফলন ঘটানোর জন্য। “বাংলা” শব্দটি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নির্দেশ করে, যা দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়। “দেশ” শব্দটি ভৌগোলিক সীমানা ও রাজনৈতিক সত্তাকে নির্দেশ করে। একসঙ্গে, “বাংলাদেশ” নামটি দেশের বাঙালি অধিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ভূগোলের একটি সমন্বিত প্রতীক। এটি এমন একটি নাম যা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে, কারণ এটি বাংলাদেশের সকল নাগরিকের পরিচয়ের প্রতিনিধিত্ব করে।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় ‘বাংলাদেশ’ নামটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। এবং এটিই স্বাধীনতার পরের জাতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকার প্রথমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে পরিচিত ছিল। যুদ্ধকালীন সরকারের সদর দপ্তর ছিল মুজিবনগরে।

বাংলাদেশ নামকরণের পেছনে কয়েকটি কারণ

বাংলাদেশ নামকরণের পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, ‘বাংলা’ শব্দটি অঞ্চলটির ভৌগোলিক অবস্থান এবং এর বাংলা ভাষী জনগণের প্রতিফলন করে। দ্বিতীয়ত, ‘দেশ’ শব্দটি অঞ্চলের স্বাধীনতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতীক।

নামটির প্রস্তাবক ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এই নামটি দেশটির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং অভিপ্রায়কে সবচেয়ে ভালোভাবে প্রতিফলিত করে। তাঁর প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় এবং ‘বাংলাদেশ’ নামটিই অবশেষে দেশটির সরকারি নাম হিসেবে নির্বাচিত হয়।

নামের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি হয়। এটি একটি জাতির সংগ্রাম, আকাঙ্ক্ষা ও আত্মনির্ভরতার প্রতীক। এই নামের মাধ্যমে বাঙলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

যখন একটি জাতিকে নিজস্ব স্বাধীনতা এবং পরিচয়ের প্রয়োজন হয়, তখন সেটি প্রকাশ পাওয়ার অন্যতম শক্তিশালী উপায় হলো একটি নাম। আমাদের ক্ষেত্রে, এই নামটি হলো “বাংলাদেশ”। এটি একটি শব্দ যা আমাদের ভূগোলকে, আমাদের ইতিহাসকে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, আমাদের জাতীয়তাবাদকে নির্দেশ করে।

See also  ষষ্ঠী পূজা কেন হয়? পুজোর ইতিহাস, তাৎপর্য ও বিধি-নিষেধ

বাংলাদেশ নামের খন্ডন

“বাংলাদেশ” নামটির উৎপত্তি আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে। “বাংলা” শব্দটি এসেছে প্রাকৃত ভাষা “বাঙ্গলা” থেকে, যা আবার এসেছে সিলেটি ভাষার “বাঙ্গাল” শব্দ থেকে, যার অর্থ “বঙ্গের অধিবাসী”। আর “দেশ” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “দেশ” শব্দ থেকে, যার অর্থ “ভূখণ্ড” বা “নিজের দেশ”। তাই “বাংলাদেশ” শব্দটির আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় “বাঙালি ভাষাভাষীদের দেশ”।

এই নামটির পেছনে একটি গভীর ইতিহাস রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের অধীনে, বাংলাকে ভাগ করা হয়েছিল প্রেসিডেন্সি অফ বেঙ্গল, পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলায়। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত বিভক্ত হয়, তখন পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের একটি অংশ হয়ে ওঠে। তবে পূর্ব বাংলার জনগণ তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং পরিচয় বজায় রাখতে চেয়েছিল। তাই তারা “বাংলাদেশ” নামটি দাবি করতে শুরু করে, যা তাদের জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করার পরে, “বাংলাদেশ” নামটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এই নামটি আমাদের জাতির সংগ্রাম, আকাঙ্ক্ষা এবং আত্মনির্ভরতার প্রতীক হয়ে ওঠে। এটি বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের স্বীকৃতি দেয়।

আজকে, “বাংলাদেশ” নামটি আমাদের গর্বের উৎস। এটি আমাদের পরিচয়কে প্রতিনিধিত্ব করে, আমাদের ইতিহাসকে সম্মান করে এবং আমাদের ভবিষ্যতের প্রতি আশা জাগায়। আমরা বাংলাদেশিরা, এবং আমাদের দেশের নাম আমাদের জাতীয়তাবাদের একটি শক্তিশালী ভিত্তি।

Payel Avatar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *