বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি কে? বাংলা সাহিত্যের জনক

বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি কে? বাংলা সাহিত্যের জনক

আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্যে তার দৃঢ় অবস্থান তৈরি করেছে। যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিক মনীষীরা বিশ্ব সাহিত্যে দ্যুতি ছড়িয়েছেন, সেই বাংলা সাহিত্যের গোড়াপত্তন কবে, কীভাবে তা জানার জন্য আমাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে অতীতে। এই প্রবন্ধে, আমরা বাংলা সাহিত্যের উৎস থেকে শুরু করে তার বিভিন্ন যুগ পর্যন্ত একটি ঐতিহাসিক ভ্রমণে যাত্রা করব। আমরা জানব বাংলা সাহিত্যের জনক কে, প্রাচীনতম বাংলা সাহিত্য কোনটি, চর্যাপদের কবিগণ কারা ছিলেন, প্রাকৃত বাংলা সাহিত্য কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে, প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে কী কী বিষয়বস্তু প্রাধান্য পেয়েছে, এবং মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে কোন কোন ধারা ও প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। এই যাত্রার শেষে, আমরা বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশের একটি সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারব এবং বুঝতে পারব কীভাবে এই সমৃদ্ধ সাহিত্যিক ঐতিহ্যটি কালের পরিক্রমায় আমাদের জীবনকে স্পর্শ করেছে।

বাংলা সাহিত্যের জনক

বাংলা সাহিত্যের জগতে প্রথম কবি কে সেটা নিয়ে বেশ কিছু তত্ত্ব আছে। প্রাচীনকালে বাংলা সাহিত্যে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ছিল। বৌদ্ধ গানগুলিই বাংলা সাহিত্যের প্রথম রূপ বলে মনে করা হয়। এই গানগুলির ভাষা ছিল অপভ্রংশ বা সংস্কৃতের দেশী রূপ। এই গানগুলির মধ্যে অন্যতম হল চর্যাপদ। চর্যাপদগুলি 10 থেকে 12 শতকের মধ্যে রচিত হয়েছিল। এই চর্যাপদগুলির মধ্যে অন্যতম হল ময়নামতী গানের রচয়িতা ময়নামতী। তাই ময়নামতীকেই বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি হিসাবে গণ্য করা হয়। তাঁর রচিত চর্যাপদটি হল, “আমি করেছি ময়নামতী, ভোল পেলে যার কেহ নাই রে”। এই চর্যাপদটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম কাব্য রচনা হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

বর্তমানে পর্যন্ত পাওয়া প্রাচীনতম বাংলা সাহিত্য

চর্যাপদই ৷ চর্যাপদ হল ১০-১২ শতাব্দীতে রচিত বৌদ্ধ ধর্মী দোহা৷ চর্যাগীত বা চর্যাপদের রচয়িতাদের বলা হয় চর্যাপদকার৷ চর্যাপদকে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়৷ এগুলি বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের দ্বারা রচিত৷ চর্যাপদগুলি তাঁদের আধ্যাত্মিক অনুভূতি এবং তাঁদের সাধনার কথা বলে৷ এগুলি বাংলা ভাষার প্রাচীনতম রূপগুলির একটি৷ চর্যাপদগুলির ভাষা মধ্যযুগীয় বাংলা৷ এটি আধুনিক বাংলা থেকে অনেকটাই আলাদা৷ চর্যাপদগুলির লিপিও আধুনিক বাংলা লিপি থেকে আলাদা৷ চর্যাপদগুলির আবিষ্কার ১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী করেন৷ এগুলি তিনি নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে পান৷ চর্যাপদগুলির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালে৷

See also  বেগম রোকেয়া: বাংলা সাহিত্যের অগ্রদূত যাঁর অবদান অসামান্য

চর্যাপদের কবিগণ

বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি হিসেবে পরিচিত। তাঁরা মূলত বৌদ্ধ সাধক ছিলেন এবং তাঁদের রচনাগুলি তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটায়। চর্যাপদগুলি মূলত গানের কথা বা স্তোত্রসমূহ, যা মূলত সংস্কৃত ও পালি ভাষার প্রভাব বহন করে। তবে এগুলিতে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম রূপগুলিরও আভাস পাওয়া যায়।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন লুইপা, কাহ্নপা, শান্তিপা, মৈত্রীপা, গোরক্ষপা, ভূষণপা এবং মিনানাথ। তাঁদের রচনাগুলি বাংলা সাহিত্যের ভিত্তি স্থাপন করেছে এবং বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁদের রচনাগুলি প্রাচীন বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মের একটি মূল্যবান উৎস প্রদান করে।

প্রাকৃত বাংলা সাহিত্য

বাংলা সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয় দিয়ে। প্রাকৃত ছিল এক প্রাচীন ভাষা, যা অপভ্রংশ থেকে উৎপন্ন হয়েছিল। ের প্রথম কবি হিসেবে পরিচিত হন কারণকমলী। তার রচিত রচনা “কালিদাস বিজয়” কাব্যটিই প্রাচীনতম সাহিত্যকর্ম হিসেবে স্বীকৃত। এই কাব্যটিতে কবি কর্ণকমলী কালিদাসের জীবনী ও তার লেখার প্রশংসা করেছিলেন।

মূলত জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ ও গান দ্বারা গঠিত হয়েছিল। এ সময়ের সাহিত্যে প্রধানত ধর্মীয় উপদেশ, জীবনযাত্রার নিয়ম ও দার্শনিক চিন্তাভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে। চর্যাপদ নামে পরিচিত আধ্যাত্মিক গানগুলি ের উল্লেখযোগ্য অবদান। এগুলির রচয়িতাদের নাম জানা যায়নি, তবে এটি ধারণা করা হয় যে এগুলি ১০ম থেকে ১২শ শতকের মধ্যে রচিত হয়েছিল।

এর সঙ্গে সেন, পাল ও চোল রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই রাজবংশগুলি বৌদ্ধধর্ম এবং জৈনধর্মকে সমর্থন করেছিল, যা প্রাকৃত সাহিত্যের বিকাশে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। ভারতীয় সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার উত্থানে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিল।

প্রাচীন বাংলা সাহিত্য

এর পথে পা রাখার শুরুতেই আমাদের মনে জাগে প্রশ্ন, বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি কে? দুইটি সম্ভাব্য উত্তর সামনে আসে, চর্যাপদকার এবং কবি জয়দেব।

See also  আমার লেখা ‘নয়া চীন’ গ্রন্থের লেখকের পরিচয় | অবাক করা তথ্য

চর্যাপদ হল বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রাচীন রচনা যা বৌদ্ধ ধর্মের আদি অনুসারী সিদ্ধাচার্যদের দ্বারা রচিত হয়েছিল। ১০ম থেকে ১২শ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে রচিত ৪৬টি চর্যাপদ সংকলন পাওয়া গেছে। এই রচনাবলিতে কোনো কবির নাম পাওয়া যায়নি তবে অনেকেই মনে করেন যে এগুলোর কিছু রচয়িতা পরবর্তীকালে কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

অন্যদিকে, কবি জয়দেবকে অনেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি ১২শ শতকে রচিত সুন্দরী কাব্য গীতগোবিন্দমের রচয়িতা। এই কাব্য সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়েছে কিন্তু এটি বাংলা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণ হলো এটি বাংলার সংস্কৃতি, ভাষা এবং সাহিত্যে গভীর প্রভাব ফেলেছে। জয়দেবের সুন্দরী কাব্য গীতগোবিন্দমে ব্যবহৃত কতকগুলো শব্দ ও বাক্যাংশ পরবর্তীকালে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে।

মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য

মধ্যযুগ বাংলা সাহিত্যের সূচনা হয় ষষ্ঠ এবং সপ্তম শতকে। দুঃখের বিষয় যে, এ যুগের অধিকাংশ সাহিত্যকীর্তি কালের বিবর্তনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফলে তৎকালীন সাহিত্যের স্বরূপ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত। যদিও ১০ম ও ১১শ শতাব্দীতে চর্যপদ রচিত হয় যা আদি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন হিসাবে বিবেচিত হয়। চর্যপদগুলি বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের দ্বারা রচিত গান যা মূলত ধর্মীয় ভাবধারা নিয়ে রচিত হলেও তাতে প্রেম, প্রকৃতি এবং দার্শনিক চিন্তাভাবনারও প্রকাশ ঘটেছিল।

তবে বাংলা ভাষায় প্রথম কবি হিসেবে যাঁর নাম সর্বজনবিদিত তিনি হলেন কবি কঙ্কনা মুন্সি বা কঙ্কন মুন্সী (স‌ঠিক নাম অজানা)। তিনি ১২ থেকে ১৩ শতকে বাংলা কাব্যসাহিত্যের প্রবর্তক হিসেবে খ্যাতিমান। তার রচিত বিখ্যাত “পুণ্যবন্তী” নামক কাব্যগ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম কাব্য রচনা হিসেবে বিবেচিত হয়। “পুণ্যবন্তী” কাব্যে কবি সংসারের মুখাপেক্ষীতা পরিত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন। তার কাব্যের ভাষা সহজ ও সরল, তবে আবেগ ঘনত্বের জন্য সুপরিচিত।

Razon Avatar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *