আমাদের আধুনিক জীবন যাপনের জন্য জ্বালানি একটি অপরিহার্য উপাদান। শিল্প বিপ্লবের সময় থেকেই বাষ্পীয় ইঞ্জিন আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করে তুলেছে। এই ইঞ্জিনের আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে একটি দীর্ঘ এবং আকর্ষণীয় ইতিহাস।
আজকের এই আর্টিকেলে, আমি আপনাদের নিয়ে যাব সেই ইতিহাসের পথে। আমরা দেখব কীভাবে প্রাথমিক আবিষ্কারগুলির ভিত্তিতে টমাস সেভেরি বাষ্পীয় ইঞ্জিনের পথিকৃৎ হয়ে উঠেছিলেন। সেভেরির জীবন, কাজ এবং তার ইঞ্জিনের ডিজাইন এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানব। এরপর, আমরা আলোচনা করব সেভেরির ইঞ্জিন পরবর্তীতে কীভাবে আরও উন্নত করা হয়েছিল এবং আধুনিক যুগে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ব্যবহার সম্পর্কে জানব। তাই প্রস্তুত হন একটি যাত্রার জন্য যা আপনাকে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের বিশ্বে নিয়ে যাবে।
বাষ্প চালিত ইঞ্জিন আবিষ্কারের ইতিহাস
বাষ্প চালিত ইঞ্জিনের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করার আগে, প্রথম বাষ্প চালিত ইঞ্জিনটি কে আবিষ্কার করেছিলেন তা জানা প্রয়োজন। ১৬৯৮ সালে ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার টমাস স্যাভেরি প্রথম কার্যকর বাষ্প চালিত ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন। তিনি এটি খনি থেকে পানি পাম্প করার জন্য ব্যবহার করেছিলেন। তবে, এই ইঞ্জিনটি অত্যন্ত অদক্ষ ছিল এবং কেবল কম উচ্চতায় পানি উত্তোলন করতে পারত।
পরবর্তীতে, ১৭১২ সালে টমাস নিউকমেন একটি উন্নত বাষ্প ইঞ্জিন তৈরি করেন যা স্যাভেরির ইঞ্জিনের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী ছিল। নিউকমেনের ইঞ্জিন বায়ুমণ্ডলীয় চাপের নীতি ব্যবহার করে কাজ করত, যা এটিকে স্যাভেরির ইঞ্জিনের চেয়ে অনেক উচ্চতায় পানি উত্তোলন করতে সক্ষম করেছিল। নিউকমেনের ইঞ্জিনটি প্রায় ৫০ বছর ধরে খনিতে পানি পাম্প করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।
১৭৬৯ সালে, স্কটিশ ইঞ্জিনিয়ার জেমস ওয়াট নিউকমেনের ইঞ্জিনের আরও একটি উন্নতি আনেন। ওয়াটের ইঞ্জিনটি ডাবল-অ্যাক্টিং ছিল, অর্থাৎ এটি পিস্টনটি উভয় দিকে ঠেলে শক্তি উৎপাদন করতে পারত। এটি আরও কার্যকর ছিল এবং স্যাভেরি এবং নিউকমেনের ইঞ্জিনের চেয়ে অনেক বেশি শক্তি উৎপাদন করতে পারত। ওয়াটের ইঞ্জিনটি শিল্প বিপ্লবের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি ছিল, কারণ এটি কারখানা এবং অন্যান্য শিল্প প্রক্রিয়াগুলিতে শক্তি সরবরাহ করতে ব্যবহৃত হয়েছিল।
প্রথম বাষ্প চালিত ইঞ্জিনের আবিষ্কারক: টমাস সেভেরি
টমাস সেভেরি (১৬৫০-১৭১৫) ছিলেন একজন ইংরেজ উদ্ভাবক, যিনি প্রথম বাষ্প চালিত ইঞ্জিনের আবিষ্কারক হিসাবে স্বীকৃত। তিনি কর্নওয়ালের সিলভারটন শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং একজন সামরিক প্রকৌশলী হিসাবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তিনি অস্ত্র এবং গোলাবারুদ তৈরিতে কাজ করেছিলেন, কিন্তু পরে খনিতে পানি নিষ্কাশনের উপর মনোনিবেশ করেছিলেন।
১৬৯৮ সালে সেভেরি তার প্রথম বাষ্প ইঞ্জিনটি পেটেন্ট করেছিলেন। এই ইঞ্জিনটি একটি ডিউল-এ্যাক্টিং পিস্টন ব্যবহার করত যা সিলিন্ডারের ভিতরে উপর-নিচে অসিলেট করত। পিস্টনের উপরের অংশে বাষ্প প্রয়োগ করা হত, যা পিস্টনটিকে ডানদিকে ঠেলে দিত। তারপর পিস্টনের নিচের অংশে বাষ্প প্রয়োগ করা হত, যা পিস্টনটিকে বামদিকে ঠেলে দিত। এই পদ্ধতিটি একটি ধারাবাহিক বাষ্প উৎসের উপর নির্ভর করেছিল এবং ইঞ্জিনটি প্রায় এক মিনিটে ১২ থেকে ১৫টি স্ট্রোক তৈরি করেছিল।
সেভেরির বাষ্প ইঞ্জিনটি খনন শিল্পে একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন ছিল। এটি খনি থেকে পানি পাম্প করতে ব্যবহৃত হত এবং খননকারীদের গভীর খনন করার অনুমতি দিয়েছিল। সেভেরির ইঞ্জিনটি অন্যান্য শিল্পেও ব্যবহৃত হত, যেমন সিডার এবং মইন। এটি ১৮ শতকের শেষের দিকে জেমস ওয়াট্টের আরও উন্নত বাষ্প ইঞ্জিনগুলির আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত ব্যবহারে ছিল।
টমাস সেভেরির জীবন এবং কাজ
টমাস সেভেরি ইংল্যান্ডের একজন উদ্ভাবক এবং প্রকৌশলী ছিলেন। তিনি বিশেষ করে বাষ্প ইঞ্জিনের প্রাথমিক উন্নয়নে তার ভূমিকার জন্য পরিচিত।
সেভেরির জন্ম ১৬৫০ সালে ডেভনশায়ারে। তিনি অক্সফোর্ডের কলেজ অফ ক্রাইস্ট চার্চে শিক্ষা লাভ করেন, যেখানে তিনি বিজ্ঞানে আগ্রহী হন। স্নাতক হওয়ার পর তিনি লন্ডনে চলে যান এবং সেখানে একজন সামরিক প্রকৌশলী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
১৬৯৮ সালে, সেভেরি বাষ্প ইঞ্জিনের একটি নতুন নকশা তৈরি করেন। তার ইঞ্জিনটি আগের নকশাগুলির চেয়ে বেশি দক্ষ এবং নির্ভরযোগ্য ছিল এবং এটি খনি, কারখানা এবং জাহাজে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। সেভেরির ইঞ্জিনটি বাষ্প শক্তির উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং শিল্প বিপ্লবের সূচনা করতে সাহায্য করে।
সেভেরি ছিলেন একজন বহুমুখী উদ্ভাবক যিনি বাষ্প ইঞ্জিন ছাড়াও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেও বিশিষ্ট অবদান রেখেছেন। তিনি একটি নতুন পানি পাম্প, একটি সুপারহিটার এবং একটি ম্যানোমিটার উদ্ভাবন করেছেন। তিনি জলবাহী এবং নিউম্যাটিক্স বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।
সেভেরি ১৭১৫ সালে মারা যান। তাকে সকল সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবকদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার কাজ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব এনেছিল এবং আধুনিক বিশ্বকে আকৃতি দিতে সাহায্য করেছিল।
সেভেরির বাষ্প চালিত ইঞ্জিনের নকশা এবং কার্যকারিতা
প্রথম বাষ্প চালিত ইঞ্জিনটির নকশা ও কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা করার আগে, আমাদের জানতে হবে প্রথম বাষ্প চালিত ইঞ্জিনটি কে আবিষ্কার করেছিলেন। এই মহান আবিষ্কারটির কৃতিত্ব ইংরেজ উদ্ভাবক টমাস স্যাভেরির কাছে যায়। ১৬৯৮ সালে তিনি এই বিপ্লবকর যন্ত্রটির পেটেন্ট করেন। স্যাভেরি ইঞ্জিন নামে পরিচিত এই ইঞ্জিনটি শিল্প বিপ্লবের সূচনার পথে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল।
বাষ্প চালিত ইঞ্জিনের পরবর্তী উন্নয়ন
প্রথম বাষ্প চালিত ইঞ্জিন আবিস্কারের পর আমার মনে প্রশ্ন এসেছিল, এই যন্ত্রের পরবর্তী উন্নয়ন কেমন ছিল? আমি অনেক গবেষণা করে জেনেছি যে, এই অপূর্ব আবিষ্কারের পরবর্তী উন্নয়নগুলো আরও দক্ষ এবং কার্যকর ছিল।
এরপরকার উন্নয়নে, ইঞ্জিনে কন্ডেন্সার যুক্ত করা হয়েছিল যা জলীয় বাষ্পকে তরলে ঘনীভূত করে এবং এর ফলে ইঞ্জিনের দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর পরে, উচ্চ চাপের বাষ্প ব্যবহার করা শুরু হয়, যা আরও শক্তিশালী ইঞ্জিন তৈরি করতে সহায়তা করে। একই সঙ্গে, ডাবল অ্যাক্টিং ইঞ্জিন তৈরি করা হয়েছিল, যা পিস্টনের উভয় দিকে বাষ্পের চাপ ব্যবহার করতে সক্ষম ছিল, যা ইঞ্জিনের ক্ষমতা আরও বাড়িয়েছিল।
এছাড়াও, স্লাইড ভাল্বের পরিবর্তে কর্liss ভাল্ব ব্যবহার করা হয়েছিল, যা বাষ্পের আরও সুনিয়ন্ত্রিত প্রবাহ নিশ্চিত করেছিল। এই সমস্ত উন্নয়ন একত্রিত হয়ে বাষ্প চালিত ইঞ্জিনগুলিকে শিল্প বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
আধুনিক বাষ্প চালিত ইঞ্জিনের ব্যবহার
বাষ্প চালিত ইঞ্জিনের আবিষ্কার মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। প্রথম বাষ্প চালিত ইঞ্জিনটি তৈরি করেন ইংরেজ সামরিক প্রকৌশলী ও উদ্ভাবক টমাস সেভারি। ১৬৯৮ সালে তিনি একটি বাষ্প চালিত পাম্প তৈরি করেন যা পানি পাম্প করতে ব্যবহৃত হতো। এই পাম্পটিতে বাষ্পকে একটি পাত্রে সঞ্চিত করে উত্তপ্ত করা হতো। বাষ্পের চাপে পাত্রের পানি একটি পাইপের মাধ্যমে উপরে উঠে যেত।
সেভারির বাষ্প চালিত পাম্প ব্যবহারিক দিক থেকে খুব কার্যকর ছিল না কারণ এটি খুব বড় ও ভারী ছিল এবং খুব বেশি শক্তি ব্যবহার করত। তবে, তার এই আবিষ্কার পরবর্তীতে অন্যান্য উদ্ভাবকদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠে। ১৭১২ সালে থমাস নিউকোমেন নামক একজন ইংরেজ লোহার কারিগর সেভারির পাম্পের একটি উন্নত সংস্করণ তৈরি করেন। নিউকোমেনের বাষ্প চালিত ইঞ্জিন খনন শিল্পে পানি পাম্প করার জন্য ব্যবহৃত হতো।
১৭৬৯ সালে স্কটিশ উদ্ভাবক জেমস ওয়াট নিউকোমেনের বাষ্প চালিত ইঞ্জিনে আরও কিছু উন্নতি করেন। ওয়াটের ইঞ্জিন সেভারি এবং নিউকোমেনের পাম্পের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী ছিল। এটি কম শক্তি ব্যবহার করত এবং আরও বেশি কাজ করতে পারত। ওয়াটের বাষ্প চালিত ইঞ্জিন শিল্প বিপ্লবের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ছিল। এটি কারখানায় যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য ব্যবহৃত হতো এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছিল।
আধুনিক বাষ্প চালিত ইঞ্জিন বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন, জাহাজ চালনা এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এই ইঞ্জিনগুলি সাধারণত জলকে সিদ্ধ করে উৎপাদিত বাষ্পের চাপ দ্বারা চালিত হয়। বাষ্পটি একটি টারবাইন ব্লেডের ওপর প্রবাহিত হয়, যা একটি জেনারেটরকে ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বাষ্প চালিত ইঞ্জিনগুলি তাদের উচ্চ কার্যক্ষমতা এবং নির্ভরযোগ্যতার জন্য পরিচিত।
Leave a Reply