কলিযুগের আরাধ্য কে? জেনে নিন গীতা থেকে

কলিযুগের আরাধ্য কে? জেনে নিন গীতা থেকে

যুগ যুগান্তরের হিসেবে বর্তমানে আমরা কলিযুগে বাস করছি। হিন্দু শাস্ত্রানুযায়ী, প্রত্যেক যুগের জন্যই রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু বিধানাবলি, পূজা পদ্ধতি এবং উপাস্য। আমরা যা বর্তমানে অনুসরণ করি, তার বেশিরভাগই কলিযুগের শাস্ত্রীয় নির্দেশনা থেকে প্রাপ্ত। কিন্তু কলিযুগের সূচনা কীভাবে হয়েছিল? কে এই যুগের অধিপতি? শাস্ত্রে কীভাবে এই যুগের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে? আর এই যুগে আমাদের কীভাবে পূজা, উপাসনা করতে হবে? এই সব কিছুই আজকের এই আলোচনার বিষয়।

কলিযুগের অবতারের আগমন

কলিযুগে অবতারের আগমন

যুগ যুগ ধরে চলে আসছে পৃথিবীতে কলি যুগ। এই যুগে অধর্ম ও অন্যায়ের বহুল প্রসার ঘটে। অন্ধকার ভরে যায় চারদিকে। তখন মানব জাতির উদ্ধারের জন্য প্রকট হন বিষ্ণুর অবতার। কলিযুগে বিষ্ণুর কল্কি অবতারের আগমন হবে বলে শাস্ত্রের ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে।

কলি অবতার হিসেবে কল্কির আগমন হবে এক অশ্ব আরোহী হিসেবে। তিনি তার তরবারির আঘাতে অধর্মীদের ধ্বংস করবেন। কল্কি অবতারের আগমন ঘটবে যখন পৃথিবীতে অধর্ম ও অন্যায়ের প্রবলতা বেড়ে যাবে। তিনি প্রকট হয়ে পৃথিবীকে পাপমুক্ত করবেন এবং ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটাবেন। কল্কি অবতারের আগমন ঘটবে শেষ কলিযুগে। তিনি পৃথিবী থেকে অধর্মের বিলুপ্তি ঘটিয়ে সত্যযুগের পুনরাবৃত্তি করবেন।

শাস্ত্রে কলিযুগের প্রভু সম্পর্কে বিবরণ

কলিযুগে সাধনার সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ও পদ্ধতি সম্বন্ধে শাস্ত্রে কথিত আছে যে, কলিযুগের শ্রেষ্ঠ সাধন হল নাম-জপ। এ কলিযুগে নাম ছাড়া অন্য কোনো সাধনই ফলপ্রসূ হবে না। তিনি বলেন, নাম-জপই কলিযুগের মোক্ষদায়ী সাধন। তাই কলিযুগে সফল সাধক হতে হলে নাম-জপের নিয়ম জানা অত্যন্ত জরুরি।

নাম-জপের নিয়ম শাস্ত্রে স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। নাম-জপ করার সময় প্রথমে মলমন্ত্র গ্রহণ করতে হবে। মলমন্ত্র গ্রহণ না করে নাম-জপ করলে তা নিষ্ফল হয়। মলমন্ত্র গ্রহণ করার পর নির্দিষ্ট সংখ্যক নাম জপ করতে হবে। কত সংখ্যক নাম জপ করতে হবে তা গুরু নির্ধারণ করে দেন। নাম-জপের সময় মন একাগ্র রেখে জপ করতে হবে। মন অন্যমনস্ক হলে নাম-জপের ফল পাওয়া যায় না। নাম-জপ করার সময় সিদ্ধাসন, পদ্মাসন বা সুখাসন যেকোনো একটি আসনে বসতে হবে। দাঁড়িয়ে, হাঁটতে হাঁটতে অথবা শুয়ে নাম জপ করলে তা নিষ্ফল হয়। নাম-জপের সময় কামনা-বাসনা মুক্ত হয়ে জপ করতে হবে। কোনো কামনা-বাসনা নিয়ে নাম জপ করলে তা নিষ্ফল হয়। নাম-জপের সময় পবিত্র থাকতে হবে। অপবিত্র অবস্থায় নাম-জপ করলে তা নিষ্ফল হয়।

See also  ছয় দফা: বাঙালির ‘মুক্তির সনদ’ হওয়ার কারণ কী?

হিন্দু পুরাণে কলিযুগের উপাস্য

কলিযুগ হল চারটি যুগের মধ্যে শেষ যুগ। এই যুগে পাপ, অবিচার এবং অধর্মের প্রাধান্য থাকে। কথিত আছে এই যুগে ধর্মের রক্ষার জন্য ভগবান বিষ্ণুর পূজা করা হয়। তিনিই কলিযুগে উপাস্য দেবতা। তিনি চারহাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম নিয়ে কালিয়া নাগের উপর শায়িত অবস্থায় চিত্রিত হন। বিষ্ণুর সহধর্মিণী লক্ষ্মীদেবিকেও কলিযুগে পূজা করা হয়। কারণ তিনি সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্যের দেবী। কলিযুগে রাধা-কৃষ্ণের পূজাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই যুগে বিগ্রহ পূজার চেয়ে নাম পূজার প্রচলন বেশি। হরিনাম সংকীর্তন ও প্রেম ভক্তিকে কলিযুগের মুক্তির উপায় বলে মনে করা হয়।

যুগের প্রয়োজন অনুযায়ী উপাস্য বিবর্তন

কলিযুগের প্রয়োজন অনুযায়ী উপাস্য বিবর্তন

কলিযুগের পাপের ভারে আচ্ছন্ন মানুষের পক্ষে ত্রেতা বা দ্বাপরের উপাসনা পদ্ধতি আর কার্যকর নয়। কলিযুগের মানুষের মনে প্রবল ভোগাসক্তি, লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা। এই দুর্বল মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রয়োজন কঠোর সাধনা ও নিয়ম। তাই কলিযুগে শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর নাম-সংকীর্তনের উপাসনা পদ্ধতিই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই পদ্ধতিতে সহজেই ভগবানের প্রেমলাভ করা যায়।

নাম-সংকীর্তন একটি সহজ ও সর্বজনীন উপাসনা পদ্ধতি। এটি করতে কোনো বিশেষ যোগ্যতা বা সময়ের প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র বিশ্বাস ও আন্তরিকতার প্রয়োজন। নাম-সংকীর্তন করলে মনের অশুভ আবেগগুলো দূর হয় এবং ভগবানের প্রতি ভক্তি বাড়ে। কলিযুগে ভগবানের নাম-সংকীর্তন ছাড়া আর কোনো উপাসনা পদ্ধতি এতটা কার্যকর নয়।

বর্তমান যুগে কলিযুগের উপাস্যের গুরুত্ব

কলিযুগের উপাস্য দেবতা হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। কলিযুগে শ্রীকৃষ্ণের ভক্তিকালীন সাধনাই একমাত্র পরমলক্ষ্যের পথ। কেননা, তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন, “যে যোগে যোগীরা আমাকে লাভ করে, সেই একই রীতিতে ভক্তিযোগীরাও আমাকে প্রেমময় ভক্তির দ্বারা লাভ করে।” (ভাঃগবত গীতা, ৫.৫) যুগসন্ধিক্ষণে তাঁর উপাসনা প্রাধান্য পায়, তাঁর মন্ত্রজপ ও আরাধনা কল্যাণকর। কারণ তিনি এই যুগের ত্রাতা, অধ্যাপক, প্রেরণাদাতা এবং আমাদের পরম শরণ্য।

See also  যে কারণে জসিমউদ্দিনকে ‘পল্লী কবি’ নামে অভিহিত করা হয়

এই যুগে মানুষের চরিত্রগত দুর্বলতা নিয়ে ভাগবতে বলা হয়েছে, “সত্যের অভাব, মন অনিয়ন্ত্রিত, কাম অপ্রতিরোধ্য, প্রচুর ভয়, দুঃখবোধের বৃদ্ধি, জীবন স্বল্প ও অসুস্থতা প্রভৃতি অনেক দুঃখ এই যুগের লক্ষণ।” (ভাঃগবত ১২.২.১-২) এমন কল্পে তাঁর শরণাগতি ও ভক্তির মাধ্যমেই শান্তি পাওয়া যায়।

Payel Avatar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *