কেন আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতের রাজনৈতিক জোট ভেঙে গেলো?

কেন আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতের রাজনৈতিক জোট ভেঙে গেলো?

আমার এই লেখায় আজকে আমি আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামীর জোটের ইতিহাস নিয়ে আলোকপাত করব। এই ইতিহাস বেশ বিতর্কিত এবং জটিল। আমি চেষ্টা করব যথাসম্ভব নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই জোটের ইতিহাসকে তুলে ধরার। এই লেখাটি পড়ে আপনি জানতে পারবেন ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামায়াতের রাজনৈতিক পুনর্গঠন, আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতের জোট গঠনের কারণ, জোট ভেঙে যাওয়ার কারণ এবং শেষ পর্যন্ত জোট ভাঙার প্রভাব কী ছিল। এই লেখাটির মাধ্যমে আপনি বাংলাদেশের রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সম্পর্কে জানতে পারবেন।

আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতের জোটের ইতিহাস

যখন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে, তখন আওয়ামী লীগ ছিল দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল। জামায়াত-ই-ইসলামীও ছিল একটি প্রধান রাজনৈতিক দল, কিন্তু এটি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সাথে সহযোগিতা করেছিল। যুদ্ধের পর জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়, কিন্তু 1977 সালে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

1986 সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত জোট বেঁধে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এই জোটটি বিতর্কিত ছিল, কারণ জামায়াতকে একটি ধর্মীয় মৌলবাদী দল হিসেবে দেখা হতো। যাইহোক, এই জোট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।

আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের জোট সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদে দেশে অনেক অস্থিরতা দেখা দেয়। জামায়াতের সাথে জোটের কারণে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করে। একই সময়ে, জামায়াতের ক্ষমতা বাড়তে থাকে।

1991 সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত জোট হেরে যায়। এই নির্বাচনের ফলে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের জোট ভেঙে যায়।

আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের জোট ভাঙার কারণে দেশের রাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আসে। এই জোট ভাঙার পর দেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় মৌলবাদী দলগুলির প্রভাব কমে যায়।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা

তদন্তের পরে প্রকাশিত হামিদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদন এবং ২০০০ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় দ্বারা প্রকাশিত ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে যৌথভাবে জামায়াত অপরাধ করে।

See also  ভাস্কো দা গামার ভারত আগমনের পেছনের কারণসমূহ

জামায়াত-ই-ইসলামী যুদ্ধের শুরুর দিকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং ‘রাজাকার বাহিনী’ গঠন করে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করে। রাজাকার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাধারণ মানুষের উপর হামলা ও নির্যাতন করত।

এছাড়াও, জামায়াত পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল চিহ্নিতকরণে সহায়তা করত। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আটক এবং হত্যা করতেও সহযোগিতা করে।

যুদ্ধের পরে, জামায়াত তাদের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করে এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে মিথ্যাচার এবং অপবাদ ছড়ানো অব্যাহত রাখে। এটি বর্তমানেও বাংলাদেশে একটি বিতর্কিত রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের দ্বারা নিষিদ্ধের দাবি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামায়াতের রাজনৈতিক পুনর্গঠন

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামায়াতের রাজনৈতিক পুনর্গঠন

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী বেআইনী ঘোষণা করা হলেও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর গঠিত হওয়া খন্দকার মোশতাক সরকার কর্তৃক জামায়াতকে বৈধতা দেওয়া হয়। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত জামায়াত জিয়াউর রহমানের সরকারের অন্যতম মূল অংশীদার ছিল। কিন্তু ১৯৭৭ সালে Ziaur Rahman কর্তৃক সামরিক আইন জারি করার পর জামায়াত সরকার ও Ziaur Rahman এর বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটায়। ফলে জামায়াতকে আবারও বেআইনী ঘোষণা করা হয়।

এরপর জামায়াত আড়ালে থেকে তার রাজনৈতিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। ১৯৯১ সালে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের নির্বাচনী জোট গঠন করে। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে জামায়াত ক্ষমতায় অংশীদার হয়। এই সময়ে জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ২০০৮ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৯২টি আসন লাভ করে।

কিন্তু ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতের জোট ভেঙে যায়। এর কারণ হলো জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আওয়ামী লীগের আন্দোলন। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের नेतृত্বে ইসলামী দলগুলোর রাজনীতিকে প্রতিহত করার জন্য ১৮ দলীয় জোট গঠন করা হয়। এই জোটের প্রধান লক্ষ্য ছিল জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচার করা এবং ইসলামী দলগুলোর রাজনীতিকে প্রতিহত করা।

See also  ইতিহাসের অলিখিত অংশ গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো জানুন

১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনের ফলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জামায়াতের প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকে যুদ্ধাপরাধের জন্য ফাঁসি দেওয়া হয়। এরপর আরও কয়েকজন জামায়াত নেতাকে যুদ্ধাপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ফলে জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত একটিও আসন পায়নি।

আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতের জোট গঠনের কারণ

আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের জোট গঠনের কারণ জানার আগে এই বিষয়টি জানা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় বিষয়টি কখনোই এড়িয়ে যেতে পারেননা। ইসলাম ধর্ম বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হওয়ায় দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিতে ভোটারদের ভোট ও সমর্থন অর্জনের অন্যতম উপায় হলো ধর্মের ব্যবহার করা।

ধর্ম ব্যবহারের কারণে দেশের কিছু রাজনৈতিক দলের বিশেষত উদারনৈতিক রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্মীয় প্রভাব বিস্তারকারী সংগঠনগুলোর সাথে কখনো কখনো জোট গঠন করতে হয়েছে। যদিও এই জোট গঠন প্রায় সময়ই বিতর্কিত থেকেছে। ঠিক তেমনি একটি জোট হলো আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের জোট।

জোট ভেঙে যাওয়ার কারণ

আওয়ামী লীগের সাথে জামায়তের জোট ভেঙে যাওয়ার কারণ হচ্ছে-

১. ধর্মীয় মেরুকরণ: আওয়ামী লীগ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল, যেখানে জামায়াত একটি ইসলামী দল। এই ধর্মীয় বৈসাদৃশ্য তাদের জোটে বড় একটি ফাটল তৈরি করেছিল।

২. আন্তর্জাতিক চাপ: আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতের জোট নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমালোচনা ছিল। বিদেশী সরকার এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো জামায়াতকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার জন্য দায়ী করার দাবি জানিয়েছিল।

৩. অভ্যন্তরীণ বিরোধ: আওয়ামী লীগের মধ্যে জামায়াতের সাথে জোটের বিরোধিতাও ছিল। অনেক আওয়ামী লীগ নেতা এবং সমর্থকরা বিশ্বাস করতেন যে, জামায়াতের সাথে জোট তাদের ধর্মনিরপেক্ষ মূলনীতির পরিপন্থী।

৪. সামাজিক অস্থিরতা: জোটের ফলে দেশে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল। বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজ সংগঠনগুলি জোটের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ করেছিল। এই অস্থিরতা আওয়ামী লীগের জন্য বিব্রতকর ছিল।

See also  মুহাম্মদ বিন কাসিম: ভারত বিজয়ী অসাধারণ সেনাপতি

৫. ভোটারদের ক্ষোভ: ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াতের সাথে জোটের ফলে আওয়ামী লীগের ভোটে ক্ষতি হয়েছিল। অনেক ভোটার জোটকে ঘৃণার সাথে দেখেছিলেন, যার ফলে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন।

জোট ভাঙার প্রভাব

আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতের জোট ভাঙার ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এই জোট ভাঙার আগে, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত ছিল দুইটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল যাদের একটি মজবুত জোট ছিল। তবে, এই জোট ২০০১ সালে ভেঙে যায়, যা সরকারের পতনে এবং দেশে একটি অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টিতে একটি প্রধান ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করে।

এই জোট ভাঙার ফলে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত দু’দলের ভোটব্যাঙ্কের মধ্যে বিভাজন ঘটে। ফলে, আওয়ামী লীগের ভোট হ্রাস পায় এবং তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা হারায়। অন্যদিকে, জামায়াতের ভোট কমে যায় এবং তারা রাজনৈতিকভাবে আরো দুর্বল হয়ে পড়ে।

এই জোট ভাঙার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো, এটি বাংলাদেশে বিরোধী দলের শক্তিমত্তার পতন ঘটিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের জোট ছিল বিরোধী দলের প্রধান চ্যালেঞ্জ, কিন্তু এই জোট ভেঙে যাওয়ার পরে, বিরোধী দল আর কোন শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। ফলে, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একক প্রভাবশালী দলে পরিণত হয়েছে।

Ishti Avatar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *