বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আসলে কে বলেছিলেন? সত্যিই কি তাই?

বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আসলে কে বলেছিলেন? সত্যিই কি তাই?

আপনি কি জানেন বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হয়েছিলো? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি কে বলেছিলেন? সে বিষয়ে জানাবো এই আর্টিকেলে

আমি মনে করি, আমরা যারা বাংলাদেশি, আমাদের সবারই জানা উচিত বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন কে? এবং কেন তিনি এই বক্তব্য দিয়েছিলেন। এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের দেশের স্বাধীনতার আগের এবং পরের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা দরকার। এছাড়াও, স্বাধীনতার পর বিদেশি সাহায্যের প্রভাব আমাদের এই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বক্তব্য বুঝতে সাহায্য করবে। এই প্রবন্ধে, আমি এই সমস্ত বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। আমার বিশ্বাস, এই প্রবন্ধটি পড়ার পর আপনারা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বক্তব্যের ইতিহাস এবং এর পেছনের কারণ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাবেন।

বাংলাদেশ কে আসলে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন?

বাংলাদেশ একটি বৃহৎ বদ্বীপের দেশ হওয়ায় এর ভৌগোলিক গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা সকলেই জানি যে, বাংলাদেশ তিনটি নদীর মিলনস্থলে গড়ে উঠেছে। এই তিনটি নদী হলো গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা। এই তিনটি নদী প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পলিমাটি বয়ে নিয়ে আসে এবং সেই পলিমাটি দিয়েই গড়ে উঠেছে আমাদের বাংলাদেশ। এই পলিগঠিত বদ্বীপের প্রকৃতি আমাদের জীবনযাত্রাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।

এই বদ্বীপীয় প্রকৃতির কারণেই আমাদের দেশে বিস্তীর্ণ সমভূমি রয়েছে। এই সমভূমিগুলোতেই আমরা ফসল উৎপাদন করি এবং আমাদের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করি। এই বদ্বীপীয় প্রকৃতি আমাদের জলবায়ুকেও প্রভাবিত করে। আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং শীতকালে তুলনামূলকভাবে কম বৃষ্টিপাত হয়। এই বদ্বীপীয় প্রকৃতির কারণেই আমাদের দেশে প্রচুর নদী ও খাল রয়েছে। এই নদী ও খাল আমাদের পরিবহন ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া, এই নদী ও খালগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যায়, যা আমাদের খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

এই বদ্বীপীয় প্রকৃতির কারণেই আমাদের দেশে ব্যাপক জলাভূমি রয়েছে। এই জলাভূমিগুলো আমাদের জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই জলাভূমিগুলো বন্যার সময় পানিকে ধারণ করে রাখে এবং খরায় সময় পানি ছড়িয়ে দেয়। এই বদ্বীপীয় প্রকৃতির কারণেই আমাদের দেশে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ মৎস্যচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এই মৎস্যচাষ আমাদের দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

See also  বাংলাদেশে কোন ব্রান্ডের ফ্রিজ কেনা সবচেয়ে লাভজনক? জেনে নিন এখনই!

এইভাবে, বাংলাদেশের বদ্বীপীয় প্রকৃতি আমাদের জীবনযাত্রাকে সরাসরি প্রভাবিত করে। এই বদ্বীপীয় প্রকৃতির জন্যই আমাদের দেশে সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য রয়েছে। এই সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।

স্বাধীনতার আগের পরিস্থিতি

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পরে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল এবং দুটি অঞ্চলের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্য ছিল।

পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক ছিল, যখন পশ্চিম পাকিস্তান শিল্পোন্নত ছিল। এটির ফলে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নে বৈষম্য দেখা দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানকে উপনিবেশ হিসাবে শাসন করেছিল, তাদের নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েছিল।

পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এই অসন্তোষের প্রথম বড় প্রকাশ ছিল। এই আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বাংলাকে পাকিস্তানের একটি সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। আন্দোলনটি পাকিস্তান সরকার দমন করেছিল, তবে এটি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী भावना জাগিয়েছিল।

১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ হিসাবে একটি নতুন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের নয় মাসের সংগ্রামের পরে এসেছিল।

স্বাধীনতার পরের পরিস্থিতি

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের যে অবস্থা ছিল, তা কল্পনারও অতীত। দেশটি এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, একে তখন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলা হতো। দেশের অর্থনীতি ছিল ধ্বংসের মুখে। শিল্প-কারখানা, সড়ক-ঘাট, রেললাইন সবই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কৃষি উৎপাদনও ছিল অত্যন্ত কম। খাদ্যের জন্য দেশ ছিল প্রতিবেশী ভারতের ওপর নির্ভরশীল। চিকিৎসা ব্যবস্থা ও শিক্ষা ব্যবস্থাও ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এমনকি দেশে সরকারি কর্মচারীদের বেতন দিতেও রাজস্ব ঘাটতি ছিল। এই সব কিছুর ফলে বাংলাদেশ তখন বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল।

See also  বাংলাদেশ বনাম মিয়ানমার: যুদ্ধে কে জিতবে, কে হারবে? বিশ্লেষণ করুন

স্বাধীনতার পর বিদেশি সাহায্যের প্রভাব

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিদেশি সাহায্যে অত্যন্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। এই সাহায্যের প্রভাব দ্বিমুখী ছিল।

একদিকে, বিদেশি সাহায্য দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সহায়তার ফলে অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ এবং দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে, বিদেশি সাহায্য দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং সার্বভৌমত্বের উপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। সাহায্যদাতা দেশগুলি প্রায়ই তাদের নিজস্ব স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় এবং শর্তসাপেক্ষ সাহায্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে হস্তক্ষেপ করে। এটি দেশের আত্মনির্ভরশীলতা ও স্ব-নির্ভরতার ক্ষমতা হ্রাসে অবদান রেখেছে। তবুও, বিদেশি সাহায্যের প্রভাব একটি জটিল এবং বিতর্কিত বিষয়। এই সাহায্যের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই রয়েছে এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলি এখনও বিতর্কিত।

‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বক্তব্যের পেছনের কারণ

বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন মার্কিন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার। ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি এই বক্তব্য দিয়েছিলেন। কিসিঞ্জারের মতে, বাংলাদেশ এতই জনবহুল এবং দরিদ্র যে, এটি কখনই নিজের খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারবে না। তিনি আরও বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ বিশ্বের জন্য একটি বোঝা হয়ে উঠবে।

কিসিঞ্জারের এই বক্তব্য ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। অনেকেই এটিকে সংবেদনশীলতাহীন এবং বাস্তবতার থেকে বিচ্ছিন্ন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে, কিছু লোক কিসিঞ্জারের মতামতের সাথে একমতও হয়েছেন। তাদের যুক্তি হল যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ঘনত্ব খুব বেশি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ খুব কম, যা এটিকে স্বাবলম্বী হওয়া কঠিন করে তোলে।

বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলা হলেও, স্বাধীনতার পর থেকে দেশটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়েছে। তবে, দেশটি এখনও অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, যার মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দারিদ্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তন।

Payel Avatar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *